মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ করা জরুরি

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ করা জরুরি

ইউ এস বাংলা নিউজ ডেক্স:-
আপডেটঃ ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২ | ১০:২০
পণ্ডিতরা বলেন, নিরীহ প্রাণীকে বেশি খোঁচাতে নেই। বারবার কোনো নিরীহ জীবকে যন্ত্রণা দিলে এক পর্যায়ে সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং তার প্রতি আক্রমণকারীকে সে থাবা, আঁচড় বা কামড় দিয়ে রক্তাক্ত করতে পারে। যার ফলে অনেকের প্রাণহানিও ঘটতে পারে। বাঙালিরা সর্বদা নিরীহ সম্প্রদায় হিসাবে বিবেচিত। চারশ বছরের মুঘল শাসন ও প্রায় দুইশ বছরের ইংরেজ শাসন আমলে বাঙালিরা মোটামুটি নিরীহ জীবনযাপনই করেছে। এ সময়ে অন্যায়-অত্যাচার যে তাদের প্রতি হয়নি তা নয়, তবে তারা তার প্রতিবাদও করেছে। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসকরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দুভাগ করে হিন্দুদের জন্য ভারত ও মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামে দুটি দেশ সৃষ্টি করে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে। পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটি তৈরি হয়, তার দুটি অংশ ছিল। একটি অংশ পশ্চিম পাকিস্তান ও অপর অংশটি পূর্ব বাংলা। পাকিস্তানের এ দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব ছিল প্রায় এগারশ মাইল। একমাত্র ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া এ দুই অংশের মধ্যে আর কোনো বিষয়ে তেমন মিল ছিল না। ভৌগোলিক দূরত্ব ছাড়াও অন্যান্য সব বিষয়েই পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান থেকে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ছিল বিস্তর পার্থক্য। ভাষা ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য যার মধ্যে অন্যতম। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার প্রতি চরম অবহেলা, বৈষম্য ও নিপীড়ন শুরু করে, যার প্রতিবাদে বাঙালিরা রাস্তায় নামে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে জীবনদান এসবের মধ্যে অন্যতম। তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের প্রতি অত্যাচার ও নির্যাতন থামায়নি। ২৫ মার্চের কালরাতে নির্মম গণহত্যা চালিয়ে তারা এদেশের নিরীহ মানুষকে দমন করতে চেয়েছিল। ফলে বাঙালিরা অস্ত্র হাতে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হয়। ১৯৭১-এ দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে তারা স্বাধীন হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, এ স্বাধীনতা যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের একটি অংশ বিরোধিতা করে এবং তাদের অনেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসাবে কাজ করে। সুতরাং বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুষ্টিমেয় বাঙালি বাদে অধিকাংশের মধ্যে যে শক্তিশালী একতা ও চেতনাবোধ গড়ে উঠেছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। মুক্তিযুদ্ধে আপামর বাঙালিই বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। কারও সক্রিয় ও সশস্ত্র অংশগ্রহণ ছিল, কারও অংশগ্রহণ ছিল পরোক্ষ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে আমরা লক্ষ করি, মহান স্বাধীনতার অর্ধশতক পরেও আমাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের একতা ও চেতনা নিয়ে বিভক্তি রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে অংশটি এর বিরোধিতা করেছিল, তারা ও তাদের সহযোগীরা এখনো সক্রিয়। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালির মৌলিক ও শক্তিশালী চেতনা। এ মৌলিক ও শক্তিশালী চেতনা বুকে ধারণ করে আমাদের অগ্রবর্তী প্রজন্ম এদেশকে স্বাধীন করেছে। এ চেতনায় বিভক্তি তাই কাম্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিভক্তির প্রমাণ আমরা সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণি ও মানুষের মধ্যে দেখতে পাই। যেমন আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী এমন চেতনাবোধ কাজ করে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তাদের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বিভক্তি দেখা যায়। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনও অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী; আবার অনেকে জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যকার বিভক্তি তো আমরা শুরু থেকেই দেখে আসছি। কেন এ বিভক্তি, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কারণ, মৌলিক বিষয়ে বিভক্তি অন্যান্য বিষয়ে বিভক্তি তৈরিতে অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। নানা বিষয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে দেখা দেয় বিভাজন। এ বিভক্তির ফলে আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম হয়েছে বিভ্রান্ত। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই যে বিভ্রান্ত হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এক্ষেত্রে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বিভিন্ন সময় যারা দেশ শাসন করেছেন, তারাই মূলত এর জন্য দায়ী বলে সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তকরা মনে করেন। কারণ, তরুণদের সামনে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের মতো করে ইতিহাস রচনা করেছে। ফলে ইতিহাস নিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম বারবার বিভ্রান্তিতে পড়েছে। এটাই বিভক্তি তৈরির মূলে কাজ করেছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে। অথচ মৌলিক এ চেতনায় বিভ্রান্তি বা বিভক্তির কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়। আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেছে। অর্থনৈতিক এ উন্নয়ন নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। তথ্যপ্রযুক্তিতেও দেশ এখন অনেক এগিয়ে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছে। আর এর নেতৃত্বে রয়েছে তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীনতার মৌলিক চেতনা নিয়ে এখনো একতা তৈরি হয়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যার ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের একটি বড় অংশের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। তাদের একটি অংশ এখনো ভ্রান্ত রাজনীতির শিকারে পরিণত হচ্ছে। তাদের ভাগ করে ফেলা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, বইয়ে পড়েছে অথবা যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে শুনেছে। তারা জানে, সেই সময়ে তরুণরাই প্রধানত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া তরুণদের অনেকেই এখন দেশ চালাচ্ছেন। তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা ও সব ধরনের বিভ্রান্তি দূর করা। তাদের সঠিক পথ দেখাতে হবে। বিভক্তি রাখা চলবে না। তরুণদের বিভক্ত না করে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে দেশের উন্নয়নে লাগাতে হবে। কারণ, তারাই ভবিষ্যতে এ দেশের উন্নয়নে নেতৃত্ব দেবে। সেই সঙ্গে কমাতে হবে দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য। দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হলেও দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন। আর এ বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় তরুণদের মাঝে বিভক্তি ঘটানো সহজ বলে তারা মনে করেন। দারিদ্র্য ও বৈষম্যের কারণে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে, যা তরুণদের মধ্যে বিভক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে তারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে না। আর এর সুযোগ নিচ্ছে আদর্শহীন ও সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ তরুণরাই গড়তে পারবে। তাই তাদের বিভক্ত করার সব অপচেষ্টা রোধ করা দরকার। শিক্ষায় তার প্রতিফলন থাকতে হবে। থাকতে হবে রাষ্ট্রব্যবস্থায়। তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ এখনো এদেশের গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ‘গণ্ডগোল’ বলে জানে। তাদের অনেকেই ১৯৭১ সালকে ‘গণ্ডগোলের’ বছর হিসাবে উল্লেখ করে। এটা যে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের যুদ্ধ বা স্বাধীনতার যুদ্ধ তা তাদের বোঝাতে হবে, যাতে তাদের ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তিতে না পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনায় সবাইকে এক হতে হবে। এখানে কোনো বিভক্তির স্থান নেই। এজন্য সরকারিভাবে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। ক্যাম্পেইন, প্রশিক্ষণ, উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে হবে। বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। গণমাধ্যমকে আরও সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঠিক বিকাশ ছাড়া এদেশ থেকে দারিদ্র্য, বৈষম্য, সুদ, ঘুস, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, মাদক, চোরাচালান ও অন্যান্য সামাজিক সমস্যা দূর করা ও সংহত রাজনৈতিক পরিবেশ অর্জন সম্ভব হবে না বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ড. মতিউর রহমান : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
ট্যাগ:

সংশ্লিষ্ট সংবাদ:


শীর্ষ সংবাদ:
US Congress introduces resolution commending Bangladesh, its socioeconomic progress Bangladesh calls for urgent action for protection of climate migrants Foreign Secretary calls for empowering diaspora as development agents অবৈধ সম্পর্ক : পর্ন তারকাকে ঘুষ, আদালতে অভিযুক্ত ট্রাম্প ‘রয়্যাল’ বিষয়টা কি, আমি তা জানি না : নবাব কন্যা সারা জামিন পেয়ে আদালত থেকে বেরিয়ে আসামির মৃত্যু ৫ এপ্রিল থেকে মেট্রোরেল চলবে ৮টা থেকে ২টা ‘ইনস্টিটিউশনাল প্রাক্টিস’ চালু সরকারি হাসপাতালে রপ্তানিকারকরা প্রতি ডলারের বিপরীতে পাবেন ১০৫ টাকা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি সম্পর্কে সর্বসম্মত প্রস্তাব বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে জ্বালানির দাম কমবে : তৌফিক-ই-ইলাহী সেনাবাহিনীর দুই হেলিকপ্টারের মুখোমুখি সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে নিহত ৯ নিউইয়র্ক সিটি মেয়র এরিক অ্যাডাম কতৃক বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন পরিবারের সবাই কোটিপতি তিন কারণে প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপাবে অধিদপ্তর প্রবাসীদের উন্নয়নে জিহাদ ঘোষণা করলেও সিস্টেমের কারণে পারছি না: মন্ত্রী সুপ্রিমকোর্ট বারের নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা, আ.লীগপন্থিদের প্রত্যাখ্যান ইউপি চেয়ারম্যানের উদ্যোগে অর্ধেক দামে নিত্যপণ্য বিক্রি হজ নিবন্ধনের সময় আবার বাড়ল স্মার্ট প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হচ্ছে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট