অত্যাধুনিক ইঞ্জিনেও ওঠে না গতি

কোনোভাবেই বাড়ছে না ট্রেনের গতি। এমনকি ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন অত্যাধুনিক ইঞ্জিন-কোচ রেলবহরে যুক্ত করেও আসছে না কাঙ্ক্ষিত ফল। উলটো নেমে আসছে ৬০ কিলোমিটারে। জরাজীর্ণ রেললাইনের কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
এছাড়া ৭৩ শতাংশ ইঞ্জিন ও ৫২ শতাংশ কোচ মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ১৩৫০টি অবৈধ লেভেল ক্রসিংও গতিরোধে অনেকটা দায়ী।
অথচ গত এক যুগে রেলের উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা। চলমান আছে আরও পৌনে ২ লাখ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এর মধ্যে লাইন সংস্কারে প্রতিবছর বরাদ্দ থাকে মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু সেখানে লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া।
সারা দেশের ৩ হাজার ৯৩.৩৮ কিলোমিটার রেলপথের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ রেললাইন এখনো চরম ঝুঁকিপূর্ণ। পাশাপাশি রেলব্রিজগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
আরও জানা যায়, ৯৫ হাজার কোটি টাকার ৮৫ শতাংশ অর্থই খরচ হয়েছে নতুন রেলপথ তৈরি, রেলের ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়, রক্ষণাবেক্ষণ ও বেতনভাতা বাবদ। জরাজীর্ণ রেলপথ বরাবরই উপেক্ষিত থাকছে বছরের পর বছর। ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের মিল না থাকায় লোকসান বাড়ছে লাফিয়ে। লাগাম টানতে দুই দফা ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ যাত্রীরা।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে সময় মেনে ট্রেন চলার হার ছিল গড়ে ৮৭ শতাংশ। বর্তমানে ৬০-এর নিচে। অথচ রেলে মোটা বিনিয়োগের মূল শর্ত ছিল ট্রেনের গতি বাড়বে, শিডিউল অনুযায়ী ট্রেন চলবে। রেলপথ হবে নিরাপদ। শূন্যের কোঠায় আসবে লাইনচ্যুত ও দুর্ঘটনা। ৯০ শতাংশ লাইনচ্যুত হয় শুধু জরাজীর্ণ-ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে।
আরও জানা যায়, গত এক যুগে রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য যে খরচ করা হয়েছে, এর মধ্যে সারা দেশের রেলপথ সংস্কারে বরাদ্দ ছিল ৯০০ কোটি টাকার কম। আর গত অর্থবছরে একই খাতে (রেলপথ সংস্কার) বরাদ্দ ছিল ১১০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ১২৩ কোটি টাকা।
রেলের প্রকৌশল দপ্তরের সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-রেলপথ সংস্কারের জন্য প্রতিবছর যে কাজ করা হচ্ছে, সেটি যদি সঠিকভাবে করা হতো, তাহলে রেললাইনের অবস্থা এতটা করুণ হতো না। মূলত দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলা, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়ম হওয়ার কারণেই অর্থ খরচের পরও উন্নতি হচ্ছে না।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ হলে ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ হবে। রেলে লাগাতার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে, কয়টি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে? রেলপথ মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণে অনীহা চরম আকারে।
এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি। এত উন্নয়ন হলে যাত্রীরা কেন সুফল পাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি পদে পদে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্পদের পরিমাণ-উৎস খোঁজা উচিত। রেলে উন্নয়ন প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় হচ্ছে, যেখানে দুর্নীতি থাকার শঙ্কা আছে।
রেলওয়ের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, চলমান রেলপথের প্রায় ৭৫ শতাংশই বড় ধরনের মেরামত প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর ২ বছর ধরে প্রকল্প তৈরির প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়নি। চলমান লাইন, ব্রিজ যথাযথ সংস্কারে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।
এদিকে রেলে বর্তমানে অত্যাধুনিক ট্যাম্পিং মেশিনের প্রয়োজন ন্যূনতম ১৫টি। যার মাধ্যমে রেললাইনের যাবতীয় ত্রুটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা হয়। বর্তমানে সারা দেশে এই মেশিন মাত্র ৪টি রয়েছে। যার দুটি দীর্ঘদিন অকেজো। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে হেঁটে হেঁটে রেললাইন দেখাশোনা করা হয়। তাও নিয়মিত করা হয় না।
বর্তমানে ৩৬৬টি যাত্রীবাহী এবং ৫০টি মালবাহী ট্রেন চলাচল করছে। ১৩ বছরে অত্যাধুনিক ৫৫০টি যাত্রীবাহী কোচ, ৭৮টি ইঞ্জিন, ২০ সেট ডেমু, ৫১৬টি ওয়াগন এবং ৩০টি বগি ব্রেক ভ্যান, ২টি রিলিফ ক্রেন কেনা হয়েছে। ১৪২টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। বিদ্যমান ৪৪টি ট্রেনের রুট বর্ধিত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. কামরুল আহসান বলেন, রেলে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। প্রকল্প গ্রহণ-বাস্তবায়নও হচ্ছে। কিন্তু রেলপথ সংস্কার খুবই জরুরি। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি। এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সবচেয়ে শঙ্কার জায়গা হচ্ছে, অবৈধ লেভেল ক্রসিং, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ। এসব নিয়েই আমাদের ট্রেন চালাতে হচ্ছে। আমরা অত্যাধুনিক ইঞ্জিন-কোচ ক্রয় করছি। নতুন লাইনে সর্বোচ্চ গতি নিয়ে ট্রেন চালানো সম্ভব। কিন্তু পুরোনো লাইনগুলোয় নির্ধারিত গতি নিয়ে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। চলমান লাইন সংস্কারেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। আমরা বহুবার লিখিতভাবে বিভিন্ন সংস্থার কাছে বলেছি অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ করতে। আমরা বন্ধ করলেও পুনরায় চালু করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থা এবং সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেলে মোট ৩ হাজার ৯৩.৩৮ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে মিটারগেজ ১৬৭৯.৮৩, ব্রডগেজ ৮৭৯.৮৫ এবং ডুয়েলগেজ ৫৩৩.৭০ কিলোমিটার রেলপথ আছে। রেলওয়ে প্রকৌশল দপ্তর বলছে, নতুন কিংবা পুরোনো লাইনে কোনোমতেই ৮ ইঞ্চি পুরুর কম পাথর থাকা যাবে না। তবে গত ১৩ বছরে যেসব অত্যাধুনিক রেল ইঞ্জিন ও কোচ আমদানি করা হয়েছে, সেগুলো ১৩০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন। গতি বেশি নিয়ে চলতে হলে লাইনে ১৫ থেকে ১৮ ইঞ্চি পাথর থাকতে হয়। আর উচ্চগাতির ট্রেনের জন্য প্রয়োজন ২০ থেকে ২২ ইঞ্চি পাথর। আর বাস্তব অবস্থা হচ্ছে রেলপথের প্রায় ৯০ শতাংশ স্থানে ৬ ইঞ্চি পুরু পাথর নেই। কোনো কোনো স্থানে একেবারেই পাথর নেই।
এ প্রসঙ্গে পশ্চিমাঞ্চল রেলপথের প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুল হক বলেন, রেলপথে পাথর স্বল্পতার সঙ্গে অবৈধ লেভেল ক্রসিং, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচের সমস্যাও রয়েছে। সিগন্যালিং সমস্যাও অন্যতম। কম্পিউটার বেজ সিগন্যালিং সিস্টেম নেই বললেই চলে। আমাদের পুরো জোনের মধ্যে আব্দুলপুর থেকে জয়দেবপুর এবং দর্শনা থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত কম্পিউটার বেজ সিগন্যালিং সিস্টেম আছে, যা খুবই সামান্য। অধিকাংশ রেলপথ, স্টেশন পার হতে ১৬ কিলোমিটারের নিচে গতি নিয়ে চলতে হয়। এনালগ সিস্টেম সিগন্যালিং থাকায় ইচ্ছা করলেও উচ্চগতিসম্পন্ন ট্রেন নির্ধারিত গতি নিয়ে চালানো সম্ভব নয়।
পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী দপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ পথের ১৩৫৫ কিলোমিটার রেলপথে ১৪০০-এর ওপরে লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৯০০ লেভেল ক্রসিং অবৈধ। বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর অর্ধেকের মধ্যে গেটকিপার নেই। অবৈধগুলোয় তো নেই-ই।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিয়া বলেন, পূর্বাঞ্চল রেলপথ ও রেল ব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত প্রকল্পে প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আইআইএফসি কর্তৃক সমীক্ষা করা হচ্ছে। ট্রেনের গতি বাড়াতে হলে লাইনের যথাযথ সংস্কারের বিকল্প নেই। আমরা চেষ্টা করছি, আশা করছি সমস্যার সমাধান হবে। এছাড়া বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোয় গেটম্যান নিশ্চিত করাসহ অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো বন্ধ কিংবা পরিকল্পনা অনুযায়ী রাখা সবচেয়ে জরুরি।
অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের অধিকাংশই এলজিইডির। সড়ক ও জনপথের খুব বেশি নেই। এই সংস্থাটি রেলকে টাকা দেয়, কিন্তু এলজিডি কোনো অর্থ দেয় না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, রেল নির্বিঘ্নভাবে চালাতে হলে রেলপথকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ রেলে এর উলটো। সংশ্লিষ্টরা নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ নিয়ে ব্যস্ত। রক্ষণাবেক্ষণে কারও যেন আগ্রহই নেই। ফলে উনিশ থেকে বিশ হলেই রেলপথে দুর্ঘটনা ঘটছে। অবৈধ লেভেল ক্রসিং কী করে হয়? কারা দায়ী, দায়ীদের কেন জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে না। কারণ, প্রতিবছর বহু মানুষ লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে।